মুসলমানদের কেউ কেউ মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী কেন?

মুসলমানরা মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী প্রসঙ্গে ডা. জাকির নায়েক।

প্রশ্ন: মুসলমানদের অনেকেই মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী কেন?

ডা. জাকির নায়েকের উত্তর: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অথবা ধর্ম সম্পর্কিত কোনো আলোচনা উঠলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উক্ত প্রশ্নটি মুসলমানদের দিকে ছুঁড়ে মারা হয়।

সুপরিকল্পিতভাবে, বিরামহীনভাবে প্রচারের প্রতিটি মিডিয়া থেকে আরো অসংখ্য মিথ্যা ও ভুল তথ্যসহ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হচ্ছে।

মুসলমানদের কেউ কেউ মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী কেন?

কার্যত এই ধরনের ভুল তথ্য পরিবেশন ও মিথ্যা রটনা মুসলমানদেরকে বর্বর জাতী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যই করা হয়।

ওকলাহোমায় বোমা বিস্ফোরণের পরে আমেরিকান প্রচার মাধ্যমের মুসলিম বিরোধী প্রচারণার একটি জ্বলন্ত নমুনা পাওয়া গেছে। যেখানে এই আক্রমণের নেপথ্যে 'মধ্যপ্রাচ্যের ষড়যন্ত্র' কাজ করেছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলো ঘোষণা দেয়।

অথচ মূল অপরাধী হিসেবে পরবর্তী সময়ে যাকে সনাক্ত করা হয়েছে সে ছিল 'আমেরিকান সেনা বাহিনীরই একজন সৈনিক'। আসুন এবার সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের অভিযোগ দুটি পর্যালোনা করে দেখি।

ক. মৌলবাদী শব্দের সংজ্ঞা।

মৌলবাদী এমন এক ব্যক্তি যে অনুসরণ ও আনুগত্য করে তার চিন্তা গবেষণার বিশ্বাসের মৌলনীতি ও শিক্ষাসমূহকে।

কেউ যদি ভালো ডাক্তার হতে চায় তাহলে তাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং কঠোর অনুশীলন করতে হবে ঔষধের মূল কার্যকারীতার ওপর। অর্থাৎ তাকে হতে হবে ঔষধী জগতের একনিষ্ঠ মৌলবাদী।

একইভাবে কেউ যদি গণিতবীদ হতে চায় তাহলে তাকে জানতে হবে, বুঝতে পারতে হবে এবং একাগ্র মনোযোগে অনুশীলন করতে হবে গণিতের মূল সূত্রের ওপরে। অর্থাৎ তাকে হতে হবে গণিত শাস্ত্রের মৌলবাদী।

অনুরূপভাবে কেউ যদি বিজ্ঞানী হতে চায় তাহলে তাকে জেনে নিতে হবে, বুঝতে হবে এবং গভীর গবেষণায় মত্ত হয়ে অনুশীলন করতে হবে বিজ্ঞানের মৌলতত্ত্ব ও মূল সূত্রগুলোর ওপর। অর্থাৎ তাকে হতে হবে বিজ্ঞান জগতের মৌলবাদী।

খ. সমস্ত মৌলবাদী এক রকম নয়।

সব মৌলবাদীর চিত্র যেমন একই তুলি দিয়ে আঁকা নয়। তেমনি ভালো কী মন্দ, হুট করে এরকম কোনো মন্তব্য করাও সম্ভব নয়। যেকোনো মৌলবাদীর শ্রেণীবিন্যাস নির্ভর করে তার কাজ ও কর্মের জগত নিয়ে।

একজন মৌলবাদী ডাকাত বা চোর সমাজের জন্য ক্ষতিকর অর্থাৎ সে অনাকাঙ্ক্ষিত। একজন মৌলবাদী চিকিৎসক সমাজের জন্য কল্যাণকর এবং শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র।

গ. একজন মৌলবাদী মুসলমান হতে পেরে আমি গর্বিত

আমি একজন মৌলবাদী মুসলমান। আল্লাহর অসীম দয়ায় জানি, বুঝি এবং চেষ্টা করি ইসলামের মৌলনীতিসমূহকে অনুশীলন করতে। আল্লাহর প্রতি সমর্পিত কোনো মুসলিম একজন মৌলবাদী মুসলিম আখ্যায়ীত হতে লজ্জিত হবে না।

একজন মৌলবাদী মুসলিম হতে পেরে আমি গর্বিত এবং নিজেকে সার্থক মনে করি । কারণ আমি জানি ও বিশ্বাস করি ইসলামের মৌলনীতিসমূহ বিশ্বমানবতার জন্য শুধুই কল্যাণকর।

পৃথিবীর জন্য তা আশির্বাদ স্বরূপ। ইসলামের এমন একটি মূলনীতি খুঁজে পাওয়া যাবে না যা বিশ্বমানবতার জন্য ক্ষতিকর কিংবা সামগ্রীকভাবে মানুষের স্বার্থের প্রতিকূলে।

অনেক মানুষ ইসলাম সম্পর্কে তাদের মনে বহু ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে এবং ইসলামের কিছু কিছু শিক্ষা বা বিধানকে অযৌক্তিক ও অবিচারমূলক বলে আখ্যায়ীত করে। এটা ইসলাম সম্পর্কে তাদের অশুদ্ধ ও অপ্রতুল জ্ঞানের কারণে।

কেউ যদি মুক্তবুদ্ধি মুক্তমন ও ইনসাফপূর্ণ মনোবৃত্তি নিয়ে ইসলামের শিক্ষাসমূহকে সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেন, তাহলে তার কাছে একথা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, 'ইসলাম' ব্যক্তির স্বতন্ত্র পর্যায়ে অথবা সমাজের সামগ্রীক পর্যায়ে মানবতার জন্য অফুরন্ত কল্যাণের এক অমিয় ঝর্ণাধারা।

ঘ. মৌলবাদ শব্দটির আভিধানিক অর্থ:

ওয়েবস্টার ডিকশনারী মতে, “ফান্ডামেন্টালিজম' ছিল একটি আন্দোলনের নাম। যা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আমেরিকার প্রোটেস্ট্যান্টবাদীরা গড়ে তুলেছিল।

তা ছিল আধুনিকতাবাদীদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং বাইবেলের নির্ভুল হওয়ার স্বপক্ষে কঠিন চাপ প্রয়োগ। এ নির্ভুলতার দাবী শুধু বিশ্বাস ও শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, সাহিত্য ও ঐতিহাসিক তথ্যাদির ক্ষেত্রেও।

বাইবেলের ভাষা, আক্ষরীক অর্থে তাদের সরাসরি গড কর্তৃক নির্বাচিত এ প্রেক্ষাপটে মৌলবাদ শব্দের উৎপত্তি।

সুতারাং 'মৌলবাদ' এমনই একটি শব্দ যা প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়েছিল খ্রীস্টানদের উক্ত দলের জন্য যারা বিশ্বাস করতো 'বাইবেল' কোনো ধরনের ভুল ভ্রান্তিহীন, আক্ষরিকভাবেই আল্লাহর কথা।

অক্সফোর্ড ডিকশনারী মতে 'ফাণ্ডামেন্টালিজম'- এর অর্থ- যেকোনো ধর্মের মৌলিক শিক্ষাসমূহকে কোনো প্রকার শৈথীল্য প্রদর্শন না করে কঠোর অনুশীলন, লালন ও পালন করা। বিশেষ করে ইসলামের।

আজ যখনই কেউ 'মৌলবাদ' শব্দটি ব্যবহার করে তার ভাবনায় চলে আসে এমন একজন মুসলমান যে সন্ত্রাসী।

ঙ. প্রত্যেক মুসলিমের সন্ত্রাসী হওয়াই উচিত!

প্রত্যেক মুসলিমকেই একজন সন্ত্রাসী হওয়া উচিত। সন্ত্রাসী তো তাকেই বলা হয় যে ত্রাস বা আতঙ্কের সৃষ্টি করে। যখনই কোনো ডাকাত একজন পুলিশকে দেখে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

অর্থাৎ, একজন পুলিশ ডাকাতের জন্য 'সন্ত্রাসী'। এভাবেই চোর-ডাকাত, ধর্ষণকারী, বদমাশ ও সমাজবিরোধী সকল দুষ্কৃতিকারীর জন্য একজন মুসলমানকে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসী হতে হবে। 

যখনই সমাজবিরোধী কোনো বদমাশ একজন মুসলমানকে দেখবে সে যেন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, 'সন্ত্রাসী' শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় এমন এক লোকের জন্য যে সাধারণ লোকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।

কাজেই একজন খাঁটি মুসলমান সন্ত্রাসী হবে অপরাধীদের জন্য, নিরীহ জনসাধারণের জন্য নয়। বস্তুত একজন মুসলিমকে হয়ে উঠতে হবে নিরীহ জনসাধারণের সামনে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক।

চ. একই ব্যক্তিকে একই কাজের জন্য আলাদা আলাদা নাম দেয়া হয়েছে সন্ত্রাসী এবং দেশ প্রেমিক।

ইংরেজদের গোলামী থেকে ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করল তখন ভারত স্বাধীনতার অনেক যোদ্ধা যারা গান্ধীবাদী অহিংসার পথকে সমর্থন করেনি। ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে 'সন্ত্রাসী' লেবেল লাগিয়ে দিয়েছিল।

সেই একই যোদ্ধাদের ভারতীয়রা সম্মানিত করেছে। আর সেই একই কর্মকাণ্ডের জন্য আখ্যা দিয়েছে 'দেশ প্রেমিক'।

এভাবেই দুটি ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া হয়েছিল একই লোকদেরকে একই কর্মকাণ্ডের জন্য। এক শ্রেণী যেখানে তাদেরকে বলেছে একজন 'সন্ত্রাসী'। সেখানে অন্য শ্রেণী তাদেরকে বলেছে 'দেশ প্রেমিক'।

যারা মনে করত ইংরেজদের অধিকার ছিল ভারত শাসন করার তারা তাদেরকে সন্ত্রাসী বলত। আর যারা মনে করত ইংরেজদের কোনো অধিকার নেই ভারত শাসন করার, তারা তারেদকে বলত 'দেশ প্রেমিক' এবং 'মুক্তিযোদ্ধা'।

কাজেই এ বিষয়টা হালকা করে গুরুত্বহীনভাবে দেখার কোনো উপায় নেই। কারো ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করার পূর্বে ভালো করে শুনে নিতে হবে উভয় পক্ষের যাবতীয় বক্তব্য।

অবস্থা ও প্রেক্ষিতের পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তারপর বিচার করা যেতে পারে।

ছ. ইসলাম মানে শান্তি।

ইসলাম শব্দের উৎপত্তি 'সালাম' থেকে। যার অর্থ- শান্তি। একটা জীবনব্যবস্থা। যার মৌলিক অনুসারীদের শিক্ষা দেয় পৃথিবীতে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে।

প্রতিটি মুসলিম মৌলবাদী হয়ে নিষ্ঠার সাথে শান্তির ধর্ম ইসলামের মৌলিক শিক্ষাসমূহের অনুসরণ করতে হবে। তাকে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসী হয়ে উঠতে হবে সমাজবিরোধী বদমাশদের সামনে। যাতে সমাজে ন্যায়পরায়ণতা, সুবিচার ও শান্তি-শৃঙ্খলা দিন দিন বৃদ্ধি পায় বজায় থাকে।


Post a Comment

Previous Post Next Post