ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, নবীজীর অবমাননা এ ধরনের অপমানজনক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পদ্ধতি কী?

প্রশ্নকর্তা: কিছুদিন আগে ডেনমার্কে আমাদের নবীজীকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন ছাপা হয়েছিল। এ ধরনের অপমানজনক ঘটনা যখন ঘটে তখন আমাদের কী করণীয়?

ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, নবীজীর অবমাননা এ ধরনের অপমানজনক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পদ্ধতি কী?

ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, নবীজীর অবমাননা এ ধরনের অপমানজনক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পদ্ধতি কী?

ডা. জাকির নায়েকের উত্তর: ২০০৫ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর একটি ড্যানিশ কাগজে নবী মুহাম্মদ (সা:)-কে ব্যঙ্গ করে ১২টা কার্টুন ছাপা হয়েছিল। এছাড়া এর আগে সালমান রুশদী, তসলিমা নাসরিনদের মত ব্যক্তিরাও এ ধরনের ঘটনার অবতারণা করেছিল।

আমেরিকাতেও নবীজী (সা:)-কে অবমাননা করে লেখালেখি হয়েছে। ‘Time' ম্যাগাজিনের ১৯৬৯ সালের এপ্রিল সংখ্যায় একটি রিপোর্টে এসেছিল যে, ১৮০০ থেকে ১৯৫০ এ দেড়শ বছরের মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ষাট হাজারের বেশি বই লেখা হয়েছে।

অর্থাৎ প্রতিদিন একটা বই লেখা হয়েছে। নাইন ইলেভেনের পরে ইসলামের বিরুদ্ধে লেখা বইয়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রতিদিন কয়েকটা করে বই লেখা হচ্ছে। অসংখ্য আর্টিকেল ছাপানো হচ্ছে।

মিডিয়াতেও ইসলাম বিরোধী প্রচারণা বেড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা মুসলমানরা এর জবাব কীভাবে দিব? অর্থাৎ এর প্রতিবাদ কীভাবে করব?

ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, নবীজীর অবমাননা এ ধরনের অপমানজনক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পদ্ধতিকে ৬ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

প্রথম: মিডিয়ায় উত্তর দেয়া অর্থাৎ প্রিন্ট মিডিয়া, খবরের কাগজ, স্যাটেলাইট চ্যানেল ইত্যাদি ব্যবহার করে অপপ্রচারের ভুল জবাব দেয়া বা ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেয়া। এ পদ্ধতিতে পৃথিবীর যেকোন দেশেই অপপ্রচারের ঘটনা ঘটুক না কেন তার জবাব অন্য যেকোনো প্রান্ত থেকেই দেয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়: সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানানো। এ ধরনের প্রতিবাদও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে হতে পারে।

তৃতীয়: আইনগত ব্যবস্থা তথা কোর্টে মামলা করা। এ পদ্ধতি কেবল সে দেশেই ফলপ্রসূ হতে পারে, যে দেশে আইন ব্যবস্থা কড়া এবং দীর্ঘসূত্রিতা নেই । এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ হলো আমেরিকান মুসলিম অর্গানাইজেশন কেয়ারের একটি ঘটনা।

একবার বিখ্যাত জুতো কোম্পানি নাইকি (NIKE) এমন এক ধরনের জুতো বের করলো যার পেছনের দিকে লেখাটিকে আরবী হরফের আল্লাহ লেখার মতো মনে হয়। যেটা ইসলামের জন্য অবমাননাকর।

এ কারণে কেয়ার নাইকির (NIKE) বিরুদ্ধে কেস করেছিল। তবে সে কেস কোর্টে যাওয়ার আগেই নাইকি (NIKE) কেয়ারের সাথে সমঝোতা করে এবং প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেয়।

এ টাকাটা পরে কেয়ার জন মুসলমানদের সেবামূলক কার্যক্রমে ব্যয় করে।

চতুর্থ: অর্থনৈতিকভাবে চাপ দেয়া। যেমন, ব্যবসায়িক চাপ। এ পদ্ধতিও সবদেশে কাজে নাও লাগতে পারে। যে দেশ অপপ্রচারের সাথে জড়িত যদি সে দেশের প্রেসিডেন্ট এ কার্যক্রমের নিন্দা না করে সমর্থন করে, তবে সে দেশের পণ্য বর্জন করা যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পণ্যসামগ্রী বর্জন করা হয়েছিল। ফলে আমেরিকার অনেক অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। এ ধরনের পদ্ধতি ফলপ্রসূ হবে কেবল তখনই যখন একটা বড় সংখ্যক দল এক সাথে পণ্য বর্জন করে।

পঞ্চম: রাজনৈতিক চাপ। অর্থাৎ সমস্ত মুসলিম দেশগুলোর প্রধানরা একত্রিত হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রধানকে প্রতিবাদ জানাতে পারে। তারা বলতে পারে, আপনাদের অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে নাহলে আমরা আপনাদের দেশ থেকে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নেব এ ধরনের কোনো কথা ।

ষষ্ঠ: শক্তি প্রয়োগ করে। যেমন: কুশপুত্তলিকা পুড়ানো, পতাকা পোড়ানো, অ্যামবেসিতে পাথর মারা, ভাঙচুর চালানো, এমনকি বোমা ফাটিয়ে দেয়া ইত্যাদি। প্রথম পাঁচটা পদ্ধতিতে কোন সমস্যা নেই।

কারণ, সেগুলো হলো বাক স্বাধীনতার ব্যবহার। তবে ষষ্ঠ পদ্ধতিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন যদি ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকর না হয় তাহলে কোন সমস্যা নেই। যেমন, পতাকা পুড়ানো ইত্যাদি।

তবে সেটা এমন হয় যে, সেই দেশের নিরীহ মানুষকে ধরে আটকে রাখা হলো বা হত্যা করা হলো, ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। ইসলামী দেশে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী প্রকৃত অপরাধীকে ধরে বিচার করা হলে এটা ভিন্ন ব্যাপার।

নিরীহ মানুষকে হত্যার ব্যাপারে কোরআনে সূরা মায়িদার ৩২ নং আয়াতে এসেছে, "যদি কেউ কোনো মানুষকে হত্যা করে অথচ সে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা খুনের অপরাধে অপরাধী নয়, তাহলে সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যদি কাউকে বাঁচানো হয় তাহলে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচালো।"

ডেনমার্কের একটি স্থানীয় পত্রিকায় যখন প্রথম কার্টুনগুলো প্রকাশিত হয়েছিল, তখন সে দেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রদূতগণ একত্রিত হয়ে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে এবং তিন সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে প্রতিবাদ জানালেন।

কিন্তু ড্যানিশ প্রাইম মিনিস্টার বিষয়টিকে হালকাভাবে নিলেন এবং কোনো পদক্ষেপ নিলেন না। তিন মাস পর ২০০৬ এর ২০শে জানুয়ারি একই কার্টুন ছাপানো হলো নরওয়েতে। চারটি পত্রিকায় ছাপানো হলো।

এরপর ছাপানো হলো জার্মানীতে, তারপর হাঙ্গেরীতে। প্রথম থেকেই মুসলিম বিশ্বের স্থানে স্থানে এ কার্টুনের প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। পরবর্তীতে যখন কার্টুনগুলো বিভিন্ন দেশে ছাপানো হচ্ছিল তখন সমগ্র মুসলিম একযোগে এর তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিল।

মুসলিম বিশ্বে এ প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছিল উপরে আলোচিত ৬টি পদ্ধতিতেই। মিডিয়া, ইন্টারনেটে এর উত্তর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এসব স্থানে এর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, শান্তিপূর্ণ মিছিলের মাধ্যমে।

সে সময় সৌদি আরবের পাঁচশত এর বেশি আইনজীবীদের একটি আন্তর্জাতিক কমিটি ঘোষণা করেছিল যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা হবে।

ডেনমার্কের ওপর অর্থনৈতিক চাপও সৃষ্টি করা হয়েছিল। ডেনমার্কের আয়ের অন্যতম উৎস হলো দুগ্ধজাত পণ্য সামগ্ৰী। কুয়েত একাই প্রতি বছর ১৭০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ডেনমার্ক থেকে আমদানী করত।

সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে এ আমদানীর পরিমাণ হলো প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়নেরও উপরে। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের স্বদেশ একযোগে ডেনমার্কের পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

এভাবে যখন ডেনমার্কের ব্যবসায়িক ক্ষতি হলো তখন ডেইরি ফার্মের মালিকরা মিলিত হয়ে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী ও প্রিন্টমিডিয়ার কাছে গেল এবং ব্যবস্থা নিতে বলল। প্রিন্ট মিডিয়া তখন ক্ষমা চেয়েছিল।

ইংরেজি, আরবি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে তাদের ক্ষমা চাওয়ার ভাষা স্পষ্ট ছিল, যদিও ড্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে এ ক্ষমা চাওয়ার ভাষা জোরালো ছিল না।

দোষী পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক বলল যে, 'আমরা যে কার্টুন ছাপিয়েছি তা ডেনমার্কের আইনে অবৈধ নয়, তবে যেহেতু এতে মুসলিম বিশ্ব আহত হয়েছে এ জন্য আমরা ক্ষমা চাইছি।'

অর্থাৎ অনেকটা শর্ত আরোপ করে ক্ষমা চাওয়ার মতো। যেন, কোনো দেশে ধর্ষণ অবৈধ না বিধায় সে দেশের কোনো লোক কোনো মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করে বলল যে, আমাদের দেশে ধর্ষণ বৈধ কিন্তু আপনি যেহেতু কষ্ট পেয়েছেন সেহেতু আমি দুঃখিত।

এ ধরনের কোন অযৌক্তিক নিয়ম তৈরি করার কোনো সুযোগ নেই। যা অবৈধ তা সবার জন্যই অবৈধ। যা ক্ষতিকর তা সবার জন্যই ক্ষতিকর। সেটা বৈধ নাকি অবৈধ তার ওপর ভিত্তি করে ক্ষতির পরিমাণ কমবেশি হবে না।

ডেনমার্কের উক্ত ঘটনায় রাজনৈতিক চাপও দেয়া হয়েছিল। যেমন আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ ঘটনার সাথে রাষ্ট্রদূতরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

সে পদ্ধতিতে যখন কাজ হলো না তখন সাথে সাথেই সৌদি আরব তার রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো বলল যে, তাদের দেশে ডেনমার্কের অ্যামবেসী দরকার নেই। এরপর ডেনমার্ক ক্ষমা চেয়েছিল।

শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেও এ ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। যেমন ইন্দোনেশিয়ায় ডেনমার্কের অ্যামবেসী ভাঙচুর হয়েছে, অ্যামবেসীতে পচা ডিম ছোঁড়া হয়েছে, ইরাকে ডেনমার্কের পতাকা পুড়ানো হয়েছে।

প্রতিবাদের এ পদ্ধতি যদিও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ছিল, তবে কিছু জায়গায় যেমন- ফিলিস্তিনে একজন জার্মান নাগরিককে ড্যানিশ ভেবে আটক করা হয়েছিল। যেটা প্রতিবাদের বৈধ পদ্ধতি নয়।

যদিও পরবর্তীতে তারা উক্ত লোকটির সঠিক পরিচয় পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। এভাবে ছয়টি পদ্ধতিতেই প্রতিবাদ করা হয়েছিল।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আমেরিকায় কার্টুনগুলো ছাপানো হয়নি এবং ইংল্যান্ড ডেনমার্কের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। তারা বলেছে যে, বাকস্বাধীনতা থাকতে পারে কিন্তু কোনো ধর্মের অবমাননা করার সুযোগ নেই।

আমেরিকাও নিন্দা করেছে। কারণ, তারা পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। তারা দেখেছে যে, এ ধরনের ক্যারিকেচারের কারণে অনেক টাকা লোকসান হচ্ছে।

সুতরাং নিরীহ মানুষের ক্ষতি হয় এ ধরনের কোনো কাজ ছাড়া ছয়টি পদ্ধতিতেই প্রতিবাদ করা যেতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post