দুজন নারী সাক্ষী একজন পুরুষের সমতুল্য কেন?
ডা. জাকির নায়েকের উত্তর:
ক. একজন পুরুষ সাক্ষীর বিকল্প হিসেবে দুজন নারী সাক্ষী সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
সাক্ষী প্রদান প্রসঙ্গে কুরআনের কমপক্ষে তিনটি আয়াত রয়েছে যেখানে পুরুষ ও নারীর পার্থক্য করা হয়নি।
১. উত্তরাধিকারের ওসীয়ত করার সময় সাক্ষী হিসেবে দু'জন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে।
"বিশ্বাসীগন! তোমাদের মধ্যে কেউ যখন মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে তখন অসীয়ত করতে হলে তোমাদের মধ্য থেকে সাক্ষী রেখো। তোমাদের নিজেদের মধ্যে থেকে দু'জন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। অথবা বাইরের, যখন তোমরা এ পৃথিবীর বক্ষে (কোথাও) সফরে রয়েছো, আর এমন সময় মৃত্যু এসে হাজির হয়েছে।" (সূরা মায়েদা: ১০৬)
২. তালাকের ক্ষেত্রে দু'জন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে। যেমন:
واشهدوا ذوى عدل منكم وأقيموا الشهادة لله .
অর্থ: এবং সাক্ষীর জন্য তোমাদের মধ্যে থেকে দু'জন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে বেছে নাও। আর প্রতিষ্ঠিত করো এ সাক্ষী শুধু আল্লাহর জন্য। (সূরা তালাক: ২)
৩. নারীর প্রতি ব্যভিচারের অভিযোগে চারজন সাক্ষী দাঁড় করাতে হবে।
والذين يرمون المحصنت ثم لم يأتوا بأربعة شهداء. فاجلد وهم ثمين جلدة ولا تقبلوا
لهم شهادة أبدا ج وأولئك هم الفسقون .
অর্থ: আর যারা সত্বী নারীদের সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ আনবে। তারপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে পারবে না। তাহলে তাদেরকে আশিবার বেত্রাঘাত করো। আর কোনো দিন তাদের কোনো সাক্ষ্য গ্রহন করবে না। আর এ সমস্ত লোক তারাই যারা ফাসেক। (সূরা নূর: ৪)
খ. টাকা পয়সা লেন-দেনের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের স্থলে দু'জন নারীর সাক্ষীর প্রয়োজন।
একজন পুরুষের স্থলে দু'জন নারীর সাক্ষী সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য একথা সত্য নয়। এর সত্যতা শুধু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে।
সাক্ষী সম্বন্ধে কুরআনে পাঁচটি আয়াত আছে যেখানে নারী কিংবা পুরুষ পৃথক একটি করে উল্লেখ করা হয়নি।
আর একজন পুরুষের স্থলে দু'জন নারীর সাক্ষীর কথা মাত্র একটি আয়াতে বলা হয়েছে। সূরা বাকারা ২৮২ আয়াত। এ আয়াতটির বিশেষ বৈশিষ্ট হলো কুরআনের দীর্ঘতম আয়াত এবং তা ব্যবসা ও টাকা-পয়সা লেন-দেন সংক্রান্ত।
কুরআনে বলা হয়েছে,
"হে ঈমানদারগণ! যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তোমরা একে অপরের সঙ্গে লেন-দেন করো। তাহলে তা লিখে নিও... অতঃপর তোমাদের নিজেদের মধ্যের দু'জন পুরুষকে সাক্ষী বানাও। তখন যদি দু'জন পুরুষের ব্যবস্থা না করা যায়, তবে একজন পুরুষ ও যাদের সাক্ষীর সম্বন্ধে তোমরা আস্থাশীল এমন দু'জন নারী বেছে নাও যেন একজন ভুল করলে অন্যজন স্মরণ করিয়ে দিতে পারে।" (সুরা বাকারা: ২৮২)
সকল ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তির নির্দেশ করা হয়েছে এবং সেখানে দু'জন সাক্ষী রাখার কথা বলা হয়েছে।
আর সে দু'জনই পুরুষ হতে হবে। আর যদি সে ধরনের আস্থাভাজন দু'জন পুরুষ লোকের ব্যবস্থা না করা যায় কেবল তখন, অন্তত একজন পুরুষ ও দু'জন মহিলা থাকতেই হবে।
এখানে একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ধরা যাক কেউ একজন তার একটি রোগের জন্য অপারেশন করতে মনস্থ করেছে। নিশ্চিত হবার জন্য সে সমমানের যদি দু'জন সার্জনের পরামর্শ নেবে।
কারণঃবশত দু'জন সার্জনের ব্যবস্থা করতে সে ব্যর্থ হয় তখন বিকল্প হিসেবে একজন সার্জন এবং দু'জন সাধারণ এম বি বি এস-এর পরামর্শ গ্রহণ করল।
অনুরূপভাবে ব্যবসা ও ঋণ লেন-দেনের ক্ষেত্রে দু'জন পুরুষকে সাক্ষী রাখতে বলা হয়েছে। ইসলাম চায় পরিবারের খোরপোষের জন্য উপার্জনের দায়ভার পুরুষ বহন করুক।
তাই অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব যেখানে পুরুষের কাঁধে ন্যাস্ত। পৃথিবীতে প্রচলিত সাধারণ বাস্তবতাও তাই। কাজেই অর্থনৈতিক লেন-দেনে নারীর তুলনায় পুরুষই সুদক্ষ।
বিকল্প হিসেবে যে, একজন পুরুষ ও দু'জন নারীর কথা বলা হয়েছে। তার সুস্পষ্ট কারণও বলে দেয়া হয়েছে যে, একজন যদি কোনো ভুল করে বসে তাহলে অন্যজন যেন তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে।
কুরআন এক্ষেত্রে 'তা'দিল' শব্দ ব্যবহার করেছে যার অর্থ তালগোল পাকিয়ে ফেলা। অথবা ভুল করা। অনেকেই শব্দটির অর্থ করেছেন 'ভুলে যাওয়া' এটা শুদ্ধ নয়।
যা হোক আর্থিক লেনদেনই একমাত্র বিষয় যেক্ষেত্রে সাক্ষী হিসেবে একজন পুরুষের বিকল্প দু'জন নারী।
গ. হত্যা মামলার ক্ষেত্রেও সাক্ষী হিসেবে দু'জন নারী একজন পুরুষের বিকল্প।
কিছু ইসলামী আইন বেত্তাগণের মতে, হত্যা মামলার সাক্ষী প্রদানের ক্ষেত্রে নারীসূলভ আচরণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে একজন পুরুষের তুলনায় একজন নারী অতি মাত্রায় ঘাবড়ে যায়।
তার নারী সুলভ ভাবাবেগ তাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিতে পারে। এ কারণেই কিছু বিশেষজ্ঞ আলেম খুনের কেসে একজন পুরুষের বিকল্প হিসিবে দু'জন নারীর সাক্ষী এই রায় দিয়েছেন।
বাদবাকি ব্যাপারে একজন নারীর সাক্ষী এক জন পুরুষের সাক্ষীর সমান মূল্যমানের।
ঘ. কুরআন সুস্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছে- একজন নারীর সাক্ষী একজন পুরুষের সমান।
কিছু বিশেষজ্ঞ আলেম যদিও এ সম্পর্কে জোরালো মতামত দিয়েছেন যে, একজন পুরুষের সাক্ষীর বিকল্প দু'জন নারীর সাক্ষী, বিষয়টা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু নির্দ্বিদায় একথা মেনে নেয়া যায় না। কেননা কুরআন নিজে তা সমান করে দিয়েছে।
أزواجهم ولم يكن لهم شهدا ، إلا أنفسهم فشهادة أحدهم أربع شهدت بالله
والذين يرمون لا أنه لمن الشدقين .
অর্থ: আর যারা তাদের স্ত্রীদের সম্পর্কে অভিযোগ করবে অথচ তাদের কাছে তাদের নিজেদের বাদে অন্য কোনো সাক্ষদাতা নেই। তাহলে তাদের একজনের সাক্ষ্যই চার বার গ্রহণ যোগ্য হবে। (সূরা নূর: ৬)
ঙ. হযরত আয়েশা (রা)-এর একক সাক্ষী হাদীসের বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে গ্রহনযোগ্য।
মুসলমানদের নিকট নির্দেশনার জন্য কুরআনের পরেই মূল্যবান উৎস হলো হাদীস, সেই হাদীসসমূহের মধ্যে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত ২২২০ খানা হাদীস কেবল মাত্র তাঁর একক সাক্ষীর ওপরে ভিত্তি করেই বিশুদ্ধতার সকল বিবেচনায় উত্তীর্ণ।
কাজেই ক্ষেত্র অনুযায়ী একজন নারীর সাক্ষীই যে গ্রহণযোগ্য, এরপর তার জন্য আর কোনো দলিলের প্রয়োজন পড়ে না।
ইসলামী আইন-শাস্ত্ৰবীদগণের অনেকেই এ ব্যাপারে একমত যে, চাঁদ দেখার সম্বন্ধে একজন 'মো'মেনা' নারীর স্বাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য। বিষয়টা নিশ্চয় ভেবে দেখার মতো।
অনুরূপভাবে ইসলামের 'রোযা'র কার্যকরিতার ব্যাপারে সমস্ত মুসলিম জনগোষ্ঠি একজন মাত্র নারীর সাক্ষী দানের ওপরেই নির্ভর করতে পারে।
আবার কোনো কোনো ইসলামী পণ্ডিত বলেছেন, রমযানের চাঁদ দেখার জন্য একজন সাক্ষী এবং ঈদের চাঁদ দেখার জন্য দু'জন সাক্ষীর প্রয়োজন। সাক্ষীগণের পুরুষ বা নারী হওয়ার ব্যাপারে কোনো শর্ত নেই।
চ. বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মহিলাদের সাক্ষী অগ্রগণ্য।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নারীর সাক্ষীই গ্রহণযোগ্য, যেক্ষেত্রে পুরুষের কোনো ভূমিকাই নেই। যেমন, কোনো মহিলা মাইয়্যেতের গোসল করানোর সাক্ষী একজন নারীর পক্ষেই হওয়া সম্ভব।
দৃশ্যত সাক্ষীদানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় তা আদৌ লিঙ্গ বৈষম্যের জন্য নয়। বরং তা ইসলামের বিবেচনায় সমাজে নারী ও পুরুষের প্রকৃতি ও ভূমিকার পার্থক্যের দরুন।