ইসলাম ধর্মে মদপান নিষিদ্ধ কেন?

মদ্যপান ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ কেন?

ডা. জাকির নায়েকের উত্তর: বহু যুগ ধরে বিশ্বমানবতার জন্য 'এ্যালকোহল' তীব্র যন্ত্রণার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

মদ অসংখ্য মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ এবং বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের ভয়ঙ্কর দুর্দশার কারণ। মানুষের সমাজে অসংখ্য সমস্যার নেপথ্যে আসল কারণ এই 'এ্যালকোহল' বা মদ।

অপরাধ প্রবণতার উর্ধগতি, ক্রমবর্ধমান মানসিক বিপর্যয় এবং কোটি কোটি ভাঙা ঘর-সংসার জীবন্ত প্রমাণ বহন করছে। সারা বিশ্বে এ্যালকোহলের নিরব তাণ্ডবলীলা চলছে।

মদ্যপান ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ কেন?

ক. আল কুরআনে মদ্য পানের নিষিদ্ধতা

باتها الذين أمنوا إنما الخمر والميسر والانتصاب والأزلام رجس من عمل الشيطن

فاجتنبوه لعلكم تفلحون -

অর্থ: হে ঈমানদারগণ। মদ ও জুয়া, পাশা খেলা, তীর ছুঁড়ে ভাগ্য নিরূপণ করা এগুলো শয়তানের নিকৃষ্ট ধরনের জঘন্য কারসাজি। এসব পরিহার করো যেন তোমরা উন্নত (মানবতার) পথে অগ্রসর হতে পারো। (সূরা মায়েদা ৯০)

খ. বাইবেলে মদের নিষিদ্ধতা

১. আর মদ্য পানে মাতাল হয়ো না। (এফিসিয়ানেস: ৫:১৪)

২. মদ্য একটি প্রতারক, কঠিন পানীয়, কুৎসীত কাজের উৎসাহক এবং যে এতে অভ্যস্ত হলো সে মুর্খতায় নিমজ্জিত হলো। (বাইবেলের নীতিবাক্য, মূল গ্রন্থ: ২০-১)

গ. এ্যালকোহল বিবেককে বাধাগ্রস্ত করে

মানুষের মগজে একটি বিবেচনা কেন্দ্র বা পরিমাপক আছে। এ বিবেচনা কেন্দ্র মানুষকে সেই সকল কাজ করতে নিষেধ করে, যেসব কাজ সে মন্দ জানে।

যেমন: কোনো লোক সাধারণত তার পিতা-মাতা এবং গুরুজনের সঙ্গে কথা বলার সময় অসম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করে না।

তাকে যদি কখনো প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হয়, তাহলে তার বিবেচনা কেন্দ্র তথা বিবেক তাকে বাধা দেবে জনসমক্ষে এ কাজ করতে। এ জন্য সে গোপন জায়গা ব্যবহার করে।

মানুষ যখন মদ পান করে, তখন তার মাথার এই বিবেচনা কেন্দ্রটি স্থবির হয়ে পড়ে। মদ্য পানে মাতাল লোককে যে অস্বাভাবিক আচার আচরণ করতে দেখা যায় তার সুনির্দিষ্ট কারণ এটাই।

যেমন: মাতাল লোককে খারাপ কথা বলতে দেখা যায়, এমনকি সে যদি তার পিতা-মাতার সাথেও কথা বলতে থাকে।

কেননা সে তখন তার এই ভুলকে উপলব্ধি করতেই অক্ষম হয়ে পড়ে। মাতাল হয়ে অনেকেই পেশাব করে দেয় নিজেদের কাপড়ে।

তখন না পারে সে ঠিক মতো কথা বলতে, না পারে সোজা পায়ে হাঁটতে।

ঘ. ব্যভিচার, ধর্ষণ, এই সবকিছু মদ্যপায়ীদের মধ্যে বেশি সংঘটিত হয়

আমেরিকার ন্যাশনাল ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এর ন্যাশনাল ভিকটিমাইযেশান সারভে ব্যুরো অব জাস্টিস-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু মাত্র ১৯৯৬ সালে প্রতিদিন গড়ে ২৭১৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল।

রিপোর্টের মন্তব্যে বলা হয়েছে ধর্ষকদের অধিকাংশই ঘটনার সময় মাতাল ছিল, নারী উৎপীড়নের বেলায়ও এদেরকেই বেশি পাওয়া যায়।

একই পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায় ৮% আমেরিকান মা-বোন, অথবা মেয়ের সঙ্গে যৌন কর্মে লিপ্ত।

অর্থাৎ‍ আমেরিকার প্রতি বারো বা তেরো জনের একজন এই কুকর্মে অভ্যন্ত এবং দু'জনের একজন অথবা উভয়ে এসময় মাতাল থাকে।

এইডস্ বিস্তারের ক্ষেত্রে মাদকের ভূমিকা কান ও মাথার মতো (অর্থাৎ কান টানলে মাথা আসে)। কাজেই মাদকাসক্তিই মারাত্মক ও প্রাণঘাতি ব্যাধি।

ঙ. প্রতিটি মাদকাসক্ত লোকই শুরুতে সৌখিন পানকারী থাকে।

অনেকেই মদের পক্ষ নিয়ে বলবেন, ভাই পার্টি-পরিবেশে একটু আধটু হলে ভালোই লাগে। আমাদের দৌড় ঐ পর্যন্তই। এক কী দু’চুমুক। আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখি, আমরা মাতাল হই না ইত্যাদি।

দীর্ঘ অনুসন্ধানের রেজাল্ট এই যে, প্রত্যেকটি মদ্যপ মাতালই শুরুতে সৌখিন পানকারী ছিল। এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি যে মাতাল হওয়ার জন্য মদ পান শুরু করেছিল।

অপরদিকে কোনো সৌখিন মদখোর একথা বলতে পারবে না যে, বহু দিন যাবত এভাবেই দু'এক পেগ করেই খেয়ে এসেছি।

কোনো দিন মাত্রা অতিক্রম হয়নি। আর মাতাল হলে কেমন লাগে সে স্বাধও পাইনি।

চ. জীবনে একবারও যদি কেউ মাতাল হয়ে লজ্জাকর কিছু কাজ করে বসে সে স্মৃতি তাকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ভোগাবে।

ধরুন, কোনো সৌখিন সামাজিক মদ খোর, জীবনে শুধু একবার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাতাল হয়েছিল। আর সেই দিনই সে ধর্ষণ বা আপনজন কারো ওপরে যৌন অত্যাচার মূলক কোনো অঘটন করেছিল।

পরবর্তী কোনো সময় যদি সে, সেই কর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ক্ষমা পেয়েও গিয়ে থাকে তবুও তাকে সারাজীবন সেই স্মৃতির কুতসীৎ যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।

যা করেছে সে এবং যার ওপর তা সংঘটিত হয়েছে সে- উভয়কেই এই অপূরণীয় ক্ষতির ভোগান্তি পোহাতে হবে।

ছ. হাদীসে মদের নিষিদ্ধতা রাসূল (স.) বলেছেন:

১. মদ যাবতীয় মন্দ ও অশ্লীলতার মা (উৎস) এবং সকল মন্দের মধ্যে এটা সবচেয়ে লজ্জাকর। (সুনানে ইবনে মাজাহ্ অধ্যায় ৩০। হাদীস নং ৩৩৭১।)

২. এমন বস্তু, যা নেশাগ্রস্ত করে বেশি পরিমাণে তা নিষিদ্ধ (হারাম)। এমনকি তা স্বল্প পরিমাণ গ্রহণ করা হলেও। তাই এক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। তা এক ঢোক অথবা এক ড্রাম।

৩. হযরত আয়শা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, মদের সঙ্গে জড়িত এমন দশ শ্রেণীর লোদের ওপরে আল্লাহর লানত। (১) যারা তা তৈরী করে। (২) যাদের জন্য তা তৈরি হয়। (৩) যারা তা পান করে। (8) যারা তা বহন করে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে নিয়ে যায়। (৫) যাদের জন্য তা নিয়ে আসা হয়। (৬) যারা তা পরিবেশন করে। (৭) যারা তা বিক্রি করে। (৮) যারা তা বিক্রি লব্ধ টাকা খায়। (৯) যারা তা ক্রয় এবং (১০) যারা তা ক্রয় করে অন্য আর একজনের জন্য।

জ. মদ খোর যেসব রোগে আক্রান্ত হয়:

চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামনে এমন বেশ কিছু রোগের উৎপত্তি পরিষ্কার হয়ে গেছে যেসব রোগে সাধারণত মদ খোররাই আক্রান্ত হয়।

মদ এমন একটি ব্যাধি, যার কারণে সারা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। 

লক্ষ লক্ষ আদম সন্তান শুধু মদ পানের কারণে পৃথিবী থেকে অকালে ঝরে গেছে। সাধারণত মদ্যপায়ীরাই আক্রান্ত হয় এমন অতি পরিচিত কিছু রোগের একটি ছোট্ট তালিকা নিম্নে দেয়া হলো:

১. কলিজা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া। যা লিভার সিরোসিস নামে খ্যাত।

২. অগ্ন্যাশয় ও যকৃতের প্রদাহ।

৩. অম্ননালির ক্যান্সার এবং মাথা, গলা, কলিজা ও মল নালীর ক্যান্সার।

৪. আয়ু ও মস্তিষ্কের সমস্ত রোগ।

৫. হৃৎপিন্ডে রক্ত সঞ্চালনের নালীসমূহের সমুদয় রোগ, গলনালী প্রদাহ এবং হৃদযন্ত্র ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া।

৬. পক্ষাঘাত, সন্যাস রোগ এরকম আরো অন্যান্য প্যারালাইসিস।

৭. হৃদযন্ত্র ক্রিয়া সংক্রান্ত সকল রোগ, হাইপার টেনশান। এরকম আরো অসংখ্য রোগ রয়েছে।

ঝ. মাদকাসক্তিই একটি ব্যাধি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানিরা মদখোরদের ব্যাপারে এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তারা এটাকে এখন আর নেশা বলছেন না, বলেন এটা নিজেই একটা রোগ।

'ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন' একটা পোষ্টার বের করেছে, তাতে বলা হয়েছে যদি 'মদই' রোগ হয়ে থাকে তাহলে পৃথিবীতে এটাই একমাত্র ব্যতিক্রম রোগ যা সুন্দর সুন্দর বোতলে ভরে বিক্রি হয়।

পত্র-পত্রিকা এবং রেডিও টেলিভিশনের ন্যায় প্রচার মাধ্যমে এর বিজ্ঞাপন করা হয়। দেশের জন্য রাজস্ব আমদানী করে।

এ মৃত্যুকে যে প্রকাশ্য রাজপথে নিয়ে আসে।পারিবারিক জীবন ধ্বংস ও অপরাধ প্রবণতার মূল হোতা।

ঞ. মদ শুধু একটি ব্যাধি নয় বরং তা শয়তানের কারসাজি।

আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা মানুষের জন্য তাঁর সর্বোত্তম নেয়ামত আল-কুরআনে শয়তানের পাতানো এই লোভনীয় ফাঁদ সম্পর্কে আমদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন।

তাই কুরআনে বর্ণিত জীবন যাপন পদ্ধতিতে 'দ্বীনুল ফিল্লাহ' তথা মানুষের প্রকৃতিসম্মত জীবনব্যবস্থা 'ইসলাম' বলা হয়।

এর সকল বিধি-নিষেধের মূল উদ্দেশ্য মানব প্রকৃতিকে সমস্ত অনিষ্ট থেকে হেফাযত করা। মদ মানুষকে তার প্রকৃতগত স্বভাবের ওপর থাকতে দেয় না।

একথা কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তির বেলায় যেমন সত্য তেমনি বৃহত্তর কোনো সমাজের ক্ষেত্রেও। এটা মানুষকে নিচে নামিয়ে পশুর স্তরে নিয়ে আসে।

অথচ মানুষ দাবি করে যে, সে সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠতম। সর্বোপরি ইসলামে মদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

Post a Comment

Previous Post Next Post