ইসলাম কি তলোয়ারের দ্বারা প্রসারিত হয়েছে?

প্রশ্নকর্তা: ইসলামকে কীভাবে শান্তির ধর্ম বলা যাবে অথচ তা প্রচার ও প্রসার হয়েছে তলোয়ার দ্বারা?

ইসলাম কি তলোয়ারের দ্বারা প্রসারিত হয়েছে?

ডা. জাকির নায়েকের উত্তর: কতিপয় অমুসলিমের এটা একটা সাধারণ অভিযোগ যে, সমগ্র বিশ্বব্যাপী ইসলাম এত কোটি কোটি অনুসারী পেতে পারতো না, যদি না তা শক্তি প্রয়োগে প্রসারিত না হতো।

নিম্নে উল্লেখিত বিষয়গুলো পরিষ্কার করে দেবে, যা তলোয়ারের মাধ্যমে প্রসারের অভিযোগ খন্ডন করে দিবে। তা ছিল সত্যের সহজাত শক্তি, সঙ্গত কারণ ও মানব প্রকৃতি সম্মত যৌক্তিকতা যা এত দ্রুত ইসলামের প্রচার ও প্রসারের বাহন বা সহায়ক হয়েছে।

ইসলাম কি তলোয়ারের দ্বারা প্রসারিত হয়েছে?

ক. ইসলাম মানে শান্তি।

ইসলাম এসেছে 'সালাম' শব্দ থেকে। এর অর্থ শান্তি। এর আরো একটি অর্থ হচ্ছে, নিজের সম্পূর্ণ ইচ্ছা শক্তিকে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত করা।

এভাবে ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম, যা লাভ করা যায় সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছাকে আন্তরিক নিষ্ঠার সঙ্গে সমর্পিত করে দিলে।

খ. শান্তি বজায় রাখতে কখনো কখনো শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।

পৃথিবীর প্রতিটি লোক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুকুলে নয়। এমন মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে এর বিঘ্ন ঘটায়। সেসব ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য শক্তি প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য দেশে অপরাধী ও সমাজ বিরোধীদের দমন করার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। যাদেরকে আমরা 'পুলিশ' বলি।

ইসলাম শান্তির প্রবর্তক। একই সাথে তার অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করে জুলুম, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জালিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কখনো কখনো শক্তির প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

ইসলাম শুধু মাত্র মানুষের সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ভারসাম্যপূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই শক্তি প্রয়োগের অনুমতি দেয়।

গ. ঐতিহাসিক ডি ল্যাসী ওলেরীর মন্তব্য

বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ডি ল্যামী ওলেরী প্রণীত “ইসলাম আর্ট দা ক্রস রোড" গ্রন্থে যে মন্তব্য তিনি করেছেন তাতে “তরবারীর সাহায্যে ইসলাম প্রসারিত হয়েছে" এই ভ্রান্ত ধারণায় যারা নিমজ্জিত- তাদের জন্য দাঁত ভাঙ্গা জবাব।

"অবশেষে ইতিহাসই একথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে, ধর্মান্ধ মুসলমানদের কাহিনী হলো, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তারা তাড়া করে বেরিয়েছে আর বিজিত জাতিদেরকে তরবারীর অগ্রভাগে রেখে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছে।"

এটা অনেকগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কল্পনাপ্রসূত, উদ্ভট ও অবাস্তব কাহিনী যা ঐতিহাসিকরা বেশি বেশি পুনরাবৃত্তি করেছেন"।

ঘ. মুসলমানরা দীর্ঘ আটশত বছর স্পেন শাসন করেছে।

প্রায় আট'শ বছর স্পেন শাসন করেছে মুসলমান জাতি। সেখানে মানুষকে তরবারীর শক্তি প্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করেছে- এমন কথা চির শত্রুও বলতে লজ্জা পাবে।

আর খ্রীষ্টান ক্রুসেডাররা স্পেনে এসে সেই মুসলমানদেরকেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ফলে এমন একজন মুসলান স্পেনে ছিল না যে, তার নামাযের জন্য প্রকাশ্যে আযান দিতে পারত।

 ঙ. ১৪ মিলিয়ন আরব 'মিশরীয়' খ্রীস্টান।

সমগ্র আরব ভূখণ্ডে ১৪০০ বছর মুসলমানরাই ছিল মালিক, মনিব, শাসক। এর মধ্যে সামান্য কিছু বছর ব্রিটিশ এবং আর কয়েক বছর ফরাসীরা দখলদারিত্ব করেছিল।

সর্বোপরি মুসলিমরাই ১৪০০ বছর আরব শাসন করে আসছে। তারপর আজও সেখানে ১৪ মিলিয়ন খ্রীস্টান বংশ পরম্পরায় কীভাবে রইল? মুসলমানরা যদি তরবারী ব্যবহার করত তাহলে একজন খ্রীষ্টানও কি সেখানে এখন খুঁজে পাওয়ার কথা?

চ. ভারতে ৮০% এর বেশি অমুসলিম।

মুসলমানরা ভারত শাসন করেছে একটানা প্রায় আটশ বছর। যদি তারা ইচ্ছা করতো তাহলে তাদের সেই রাজ-শক্তি ও ক্ষমতার বল প্রয়োগ করে ভারতের প্রতিটি অমুসলিমকে ধর্মান্তরিত বানাতে পারত।

অথচ শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি অমুসলিম আজো ভারতেই আছে। তাদের প্রতিটি অমুসলিম আজ একথা সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করছে যে, "ইসলাম তরবারীর সাহায্যে প্রসারিত হয়নি।”

ছ. ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া।

ইন্দোনেশিয়া এমন একটি দেশ যেখানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক মুসলমান বাস করে আর মালয়েশিয়ার জনসংখ্যার অধিকাংশ মুসলমান। কেউ একজন প্রশ্ন করতে পারে, কোন মুসলিম সেনাবাহিনী সেখানে গিয়েছিল?

জ. আফ্রিকার পূর্বপ্রান্ত

• একই ভাবে ইসলাম দ্রুতগতিতে আফ্রিকার পূর্ব তীরে বিকাশ লাভ করে। আবারও কেউ একজন প্রশ্ন করতে পারে, ইসলাম যদি তরবারীর অগ্রভাগ দিয়েই প্রসারিত হয়ে থাকে, তাহলে আফ্রিকার পূর্বতীরে মুসলিমদের কোন বাহিনী তরবারী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল?

ঝ. থমাস কারলাইল

বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক থমাস কারলাইল তার প্রণীত 'হিরোয এন্ড হিরো ওরশিপ' গ্রন্থে ইসলামের বিকশিত হওয়া নিয়ে যে ভ্রান্ত ধারণা সে সম্পর্কে বলেছেন,

"তরবারী, কিন্তু কোথায় পাবে তুমি তোমার তরবারী? প্রত্যেকটি নতুন 'মত' তার প্রারম্ভে সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হয়- একজনের সংখ্যালঘুত্বে। শুধু একজন মানুষের মাথায়। সেখানেই তা থাকে। সারা পৃথিবীর শুধু একজন মানুষ তা বিশ্বাস করে, অর্থাৎ সকল মানুষের বিপক্ষে শুধু একজন মানুষ। একটি তরবারী সে নিল এবং তা দিয়ে তা (তার মতাদর্শ) প্রচার করতে চেষ্টা করল। তাতে তার কোনো কাজ হবে কী? তোমার তরবারী তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে। মোট কথা একটি জিনিস আপনা আপনি বিকশিত হবে যেমনটা তার ক্ষমতা আছে।"

ঙ. দ্বীন নিয়ে কোনো জবরদস্তি নেই।

কোন তরবারী দ্বারা ইসলাম বিকশিত হয়েছে? এমনকি সে তরবারী যদি মুসলমানদের হাতেও থাকতো তাহলেও তারা তা ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যবহার করতে পারত না, কারণ তাদের পথের দিশা আল কুরআন বলেছে,

إكراه في الذين ج قد تبين الرشد من الغي -

অর্থ: দ্বীন নিয়ে কোনো জবরদস্তি বা জোরাজুরি নেই। সকল ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা থেকে সত্য-পথ স্পষ্ট করে দেওয়া আছে। (২: ২৫৬)

ট. জ্ঞান ও প্রজ্ঞার তরবারী।

তা ছিল চেতনা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞার তরবারী, যে তরবারী মানুষের হৃদয়, মন ও অন্তরকে জয় করেছে। কুরআনের সূরা নাহলে ইরশাদ হয়েছে,

أدع إلى سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة وجاد لهم بالتي هي أحسن .

অর্থ: আহবান করো সকলকে তোমার প্রতিপালকের পথে প্রজ্ঞাপূর্ণ সুন্দরতম বাগ্মীতার সাথে। আর যুক্তি প্রমাণ দ্বারা আলোচনা করো তাদের সাথে এমনভাবে, যা সর্বোত্তম। (১৬১২৫)

ঠ. ১৯৩৪ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত পৃথিবীতে ধর্ম সমূহের বর্ধিষ্ণুতা

১৯৮৬ সালের রীডার্স ডাইজেন্টের 'এ্যালমানাক' সংখ্যার একটি তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধে- বিগত অর্ধ শতাব্দীতে পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মসমূহের বর্ধিষ্ণুতার হার সম্পর্কে একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রবন্ধটি “প্লেইন ট্রুথ" মাগ্যাজিনেও প্রকাশিত হয়। সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে ইসলাম- যা বেড়েছে ২৩৫% হারে। আর খ্রীষ্টবাদ বেড়েছে মাত্র ৪৭% হারে। এখানে একজন প্রশ্ন করতে পারে, মুসলমানরা কোন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এই শতাব্দীতে যা কোটি কোটি আদম সন্তানকে ধর্মান্তরীত করে মুসলমান বানিয়েছিল?

ঢ. আমেরিকা ও ইউরোপ দ্রুততম বর্ধিষ্ণু ধর্ম 'ইসলাম'।

সম্প্রতি আমেরিকায় দ্রুততম বর্ধিষ্ণু ধর্ম হচ্ছে 'ইসলাম'। মুসলমানের সংখ্যা দ্রুততার সাথে বেড়েই চলেছে ইউরোপেও। শক্তি ও বিকশিত সভ্যতার অহংকার ভূৎ হয়ে থাকা পাশ্চাত্য সভ্যতার এই সব সু-সভ্য মানুষকে এত বিরাট সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণ করতে কোন তরবারী বাধ্য করছে।

ড. ডা: জোসেফ অ্যাডাম পিয়ারসন।

ডা: জোসেফ অ্যাডাম পিয়ারসন বলেছেন, যারা আশঙ্কা করছে পারমানবিক বোমা কোনো একদিন আরবদের হাতে এসে পড়বে।

তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে যে, ইসলামী বোমা ইতিমধ্যেই ফেলে দেয়া হয়েছে। তা পড়েছে সেদিন- যেদিন মুহাম্মাদ (স) ভূপৃষ্ঠে জন্ম নিয়েছিলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন