প্রশ্নকর্তা: এমন কোনো মুসলিম কি আছে যে বিশ্বাস করে যে, পবিত্র কোরআন ও বাইবেল দুটোই আল্লাহর বাণী? এমনটি করা কি সম্ভব যে, পবিত্র কোরআন ও বাইবেল দুটোই মানবো?
বাইবেল কি আল্লাহর বাণী?
ডা. জাকির নায়েকের উত্তর: মুসলিমরা ঈসা (আ)-এর উপর অবতীর্ণ ইঞ্জিলে বিশ্বাস করে। ইসলামই একমাত্র অখ্রীস্টান ধর্ম বিশ্বাস, যেখানে ঈসা (আ)-কে নবী হিসেবে বিশ্বাস করা বাধ্যতামূলক। সে মুসলিম মুসলিম নয়, যে ঈসা (আ) কে বিশ্বাস করে না।
মুসলিমরা বিশ্বাস করে, ঈসা (আ) আল্লাহর রাসূল ছিলেন তিনি মসীহ, তার জন্ম হয়েছিল অলৌকিকভাবে কোনো পুরুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই। তিনি আল্লাহর আদেশে জীবিতকে মৃত করতে পারতেন এবং আল্লাহর আদেশে তিনি অন্ধ ও কুণ্ঠ রোগীদের সুস্থ করতে পারতেন।
ঈসা (আ)-এর উপর আল্লাহর ওহী নাযিল হয়েছিল আর সেটা হলো ইঞ্জিল। যেকোনো ব্যক্তিই যদি মনোযোগ দিয়ে বাইবেল পড়ে সে বুঝতে পারবে যে, এ বাইবেল সেই ওহী নয় যা যীশু খ্রিস্টের ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। বাইবেল শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ বিবলোস থেকে। যার অর্থ অনেকগুলো বই।
একজন খ্রীস্টান মাত্রই জানে যে, বাইবেল হলো অনেকগুলো বইয়ের সংগ্রহ। প্রোটেস্টেন্টদের মতে বইয়ের সংখ্যা হলো ৬৬ এবং ক্যাথলিকদের মতে ৭৩টি।
মুসলিমদের মধ্যে যারা শরীয়াহ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন তাদের মতে, বর্তমানে যে বাইবেল প্রচলিত তার পুরোটা আল্লাহর বাণী নয়। বাইবেলের সামান্য কিছু অংশ আল্লাহর বাণী, কিছু অংশ যীশু খ্রিস্টের কথা আর কিছু অংশ ঐতিহাসিক।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর কিছু অংশে আছে পর্ণোগ্রাফি, পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা ও অবৈজ্ঞানিক উক্তি- যেগুলোকে আল্লাহর বাণী ভাবার সুযোগ নেই। সুতরাং বর্তমান বাইবেল সেই ইঞ্জিল নয়, যা ঈসা (আ)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল।
মূলত বাইবেল একটি মিশ্র গ্রন্থ। অতএব সামগ্রিকভাবে একে আল্লাহর বাণী ভাবার সুযোগ নেই। বাইবেল ও কোরআনের মধ্যে কতগুলো জায়গায় সাদৃশ্য আছে।
মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি বলতে চাই যেহেতু আমরা জানি, ঈসা (আ)-এর ওপর আসমানী কিতাব ইঞ্জিল নাযিল হয়েছিল সেহেতু বাইবেলের সে কথাগুলো কোরআনের সাথে তথা সর্বশেষ আসমানী কিতাবের সাথে মিলে যায় আমরা সেগুলো মেনে নেব।
আপনারা যদি ওল্ড টেস্টামেন্টে ও নিউ টেস্টামেন্টের কথা বলেন তাহলে কোরআন হলো লাস্ট টেস্টামেন্ট। প্রশ্ন আসতে পারে যে, কোরআনকেও কেন মানদণ্ড হিসেবে নেব? এর উত্তর হলো, কোরআনই হল একমাত্র আসমানী কিতাব যা অপরিবর্তিত আছে।
বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করলে সবগুলো ধর্মগ্রন্থের মধ্যে কেবল কোরআনই পাস করবে। কোরআনে ম একটাও অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা নেই, নেই কোন ভুল।
ড. উইলিয়াম ক্যাম্পবেল তার একটি গ্রন্থে কোরআনের ৩০টা বৈজ্ঞানিক ভুল দেখিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে আমি তার ৩০টি যুক্তিই খণ্ডন করেছি। আমি তাকে বাইবেলের ৩৮টি বৈজ্ঞানিক ভুল দেখালাম কিন্তু তিনি সেগুলো খণ্ডন করতে পারেননি।
কোরআন হলো ফুরকান অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী। বাইবেলের যে অংশগুলো কোরআনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ সেগুলোকে আমরা তথা মুসলিমরা আল্লাহর বাণীরূপে মেনে নেব। যেমন, শুরুতে ঈসা (আ) সম্পর্কিত মুসলমানদের যে বিশ্বাসগুলোর কথা বলা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোরআন ও বাইবেলে সাদৃশ্য আছে।
কোনো কোনো খ্রীস্টানদের ধারণা যীশুখ্রিস্ট নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পুরো বাইবেলের কোথাও এ কথা নেই যে, ঈসা (আ) নিজেকে ঈশ্বর বলেছেন। অথবা বলেছেন আমার উপাসনা কর।
গসপেল অব জন ১৪ নং অধ্যায়ের ২৮ অনুচ্ছেদে যীশুখ্রিস্ট নিজের মুখে বলেছেন, "আমার পিতা আমার চাইতে মহান।"
গসপেল অব জন ১০ নং অধ্যায়ের ২৯ অনুচ্ছেদে আছে, "আমার পিতা সবার চাইতে মহান।"
গসপেল অব জন ম্যাথিউ ১২নং অধ্যায়ের ২৮ অনুচ্ছেদে আছে, "আমার ঈশ্বরের আত্মার সাহায্যে শয়তানকে তাড়িয়ে দেই।"
গসপেল অব লুক ১১ নং অধ্যায়ের ২০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "আমি ঈশ্বরের আঙ্গুলের সাহায্যে শয়তানকে তাড়িয়ে দেই।"
গসপেল অব জন ৫ নং অধ্যায়ের ৩০ নং অনুচ্ছেদে আছে, "আমি নিজের থেকে কিছুই করতে পারি না। আমি এখানে বিচার করি এবং আমার বিচার সঠিক। কারণ আমি আমার নিজের ইচ্ছাকে দেখি না আমার পিতার ইচ্ছাকে দেখি।"
যদি কেউ বলে আমি নিজের ইচ্ছাকে দেখি না আল্লাহর ইচ্ছাকে দেখি, অর্থাৎ সে আল্লাহর নিকট নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করে এমন একজন ব্যক্তিকে আরবিতে বলে মুসলিম।
সুতরাং যীশুখ্রিস্ট নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করেননি। বুক অব অ্যাকটস এর ২ নং অধ্যায়ের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে,
"হে ইসরাইলের সন্তানেরা! একথাটা কোনো নাজারাথের যীশু যে তোমাদের ঈশ্বরের প্রেরিত নবী ও ঈশ্বরের আদেশে সে অলৌকিক কাজ করেছে- তোমরা তার সাথী থাকবে।"
অর্থাৎ যীশু ছিলেন মানুষ এবং আল্লাহতায়ালা তাঁকে রাসূল করে পাঠিয়ে ছিলেন মানব জাতির হেদায়েতের জন্য। কোরআনের সাথে বাইবেলের এ সাদৃশ্য ছাড়াও আরও সাদৃশ্য আছে।
শুল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট উভয় জায়গায়ই মুহাম্মদ (সা:) এর পৃথিবীতে আসার ব্যাপারে ভবিষ্যত বাণী আছে। বুক অব ডিউটারোনোমী ১৮ নং অধ্যায়ের ১৮ নং অনুচ্ছেদে আছে, মুহাম্মদ (সা:) আসবেন।
এছাড়াও বুক অব ডিউটারনোজ্ঞামী ১৮ অধ্যায়ের ১৯ অনুচ্ছেদে, বুক অব ইসায়ইয়া ২৯ নং অধ্যায়ের ১২ নং অনুচ্ছেদে, সং অব সলোমন ৫ নং অধ্যায়ের ১৬ নং অনুচ্ছেদে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নাম উল্লেখ করে তাঁর আসার কথা বলা হয়েছে।
নিউ টেস্টামেন্টের গসপেল অব জন ১৪ নং অধ্যায়ের ১৬ নং অনুচ্ছেদে, গসপেল অব জন ১৫ নং অধ্যায়ের ২৬ নং অনুচ্ছেদে, গসপেল অব জন ১৬ নং অধ্যায়ের ৭ নং অনুচ্ছেদে, ও গসপেল অব জন ১৬ নং অধ্যায়ের ১২-১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, সর্বশেষ এ চূড়ান্ত নবী আসবেন, যার নাম মুহম্মদ (সা:)।
বাইবেলে অযু ও নামাযের ব্যাপারেও বলা আছে। যেমন- নামাজের অন্যতম প্রধান অংশ সেজদার কথা বলা আছে, বুক অব জেনেসিস বুক অব জোসেয়া ও গসপেল মেথিউতে।
ইসলামে যাকাতের কথা বলা আছে, বাইবেলও তেমনি দান করার কথা বলা আছে। বুক অব শামস ৮৪ নং অধ্যায়ের ৪ থেকে ৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "সে লোকগুলো আশীর্বাদ প্রাপ্ত যারা বাক্কা শহরে যায়।"
অর্থাৎ হজ্জের ব্যাপারেও বাইবেলে ইঙ্গিত আছে। পবিত্র কোরআনে কিছু জিনিস নিষিদ্ধ করা হয়েছে যেগুলো বাইবেলেও নিষিদ্ধ পবিত্র কোরআনে সূরা মায়িদার ৩ নং, সূরা বাকারার ১৭৩ নং, সূরা আনআমের ১৪৬ নং আয়াত এবং সূরা নাহলের ১১৫ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে “তোমাদের জন্য হারাম খাবার হল মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের মাংস আর যে পশু জবাই করার সময় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নাম নেয়া হয়েছে।"
বাইবেলেও এ জিনিসগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুক অব জেনেসিস, বুক অব লেভিটিকাস ও বুক অব ডিউটারোনোমীতে রক্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুক অব ডিউরোনোমী ১৪ নং অধ্যায়ের ১৮ নং অনুচ্ছেদে ও বুক অব ইসাইয়া ৬৫ নং অধ্যায়ের ২-৫ নং অনুচ্ছেদে আছে শূকরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুক অব অ্যাক্টস ১৫ নং অধ্যায়ের ২ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে প্রাণীগুলো জবাই করার সময় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নাম নেয়া হয়েছে সেগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কোরআন ও বাইবেলে এ ধরনের আরও অনেক সাদৃশ্য আছে। ইসলামী শরীয়াহর নিয়ম অনুযায়ী ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য নিয়ম হলো
মহিলাদের মাথা ঢাকতে হবে পুরো শরীর ঢেকে রাখতে হবে, ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে এবং পুরুষ বা মহিলা কেউই বিপরীত লিঙ্গের মত পোশাক পরতে পারবে না। বাইবেলের বুক অব ডিউটারোনোমী ২২৫ নং অধ্যায়ের ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “পুরুষরা এমন কোন পোশাক পরতে পারবে না যেটা মেয়েদের মতো হয় এবং মেয়েরাও পুরুষদের পোশাক পরবে না। এরকম পোশাক যারা পরে তারা সবার ঘৃণার পাত্র।"
সুতরাং বাইবেলেও বিপরীত লিঙ্গের ন্যায় পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফাস্ট টিমোখীর ২য় অধ্যায়ের ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "মহিলারা পোশাক পরবে ভদ্রতার সাথে, তারা শরীর ঢেকে রাখবে, শালীন পোশাক পরবে ও দামী গহনা তথা স্বর্ণ বা মুক্তার কিছু পরবে না।"
ফাস্ট কোরিথিয়ানুসের ১১ নং অধ্যায়ের ৫ থেকে ৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "যে মহিলা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার সময় তার মাথা ঢাকে না, সে নিজেকে অসম্মান করে, তার মাথার চুল ছেটে ফেলতে হবে।"
অথচ কোরআন বা হাদীসে এত কঠিনভাবে কোথাও বলা হয়নি যে মাথা না ঢাকলে তা কামিয়ে দিতে হবে। আপনারা মা ম্যারীর ছবি বা গীর্জার নানদের দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, মহিলাদের কীভাবে পোশাক পরতে হবে।
মুসলিম মহিলারাও এভাবে নিজেদের পুরো শরীর ঢেকে রাখে, শুধু মুখ ও হাত কবজি পর্যন্ত খোলা থাকে। এভাবে আরও সাদৃশ্য দেখানো সম্ভব। এজন্য আমার মতে, খ্রীস্টান বলতে যদি তাকে বুঝায় যে যীশু খ্রিস্টের অনুসরণ করে তাহলে মুসলিমরা খ্রীস্টানদের চেয়ে অনেক বেশি খ্রীস্টান।
বাইবেলে মদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুক অব একিসিয়ানস ৫ নং অধ্যায়ের ১৮ নং অনুচ্ছেদ ও বুক অব প্রোকাইস ২০ নং অধ্যায়ের ১ নং অনুচ্ছেদে নির্দেশ করা হয়েছে যে, "তোমরা মদ পান করো না।"
অথচ দেখুন মুসলিমরা মদ না পান করলেও খ্রীস্টানদের অনেকেই মদ পান করে। মুসলিমরা খাৎনা দেয়। গসপেলে বলা আছে, যীশু খ্রিস্টের খাৎনা দেয়া হয়েছিল অষ্টম দিনে।
সুতরাং ব্রিস্টের অনুসারী হিসেবে খ্রীস্টানদেরও খাৎনা দেয়ার কথা, কিন্তু অধিকাংশ খ্রীস্টানরা খাৎনা দিচ্ছে না, মুসলিমরা এ হুকুমটি অনুসরণ করছে।
সুতরাং পুরো বাইবেলও মহান ঈশ্বরের বাণী নয় বরং এর অংশবিশেষ মহান ঈশ্বরের বাণী, যেটা কোরআনের সাথে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে খুঁজে বের করতে হবে।
অতঃপর সে অংশটুকু মেনে চলতে মুসলিমদের কোনো সমস্যা নেই। যদি খ্রীস্টানরাও সে অংশটুকু মেনে চলে, তবেই মুসলিম ও খ্রীস্টানরা এক হতে পারবে।