মুসলমানরা এত দলে বিভক্ত কেন? বিভক্তি দূর করার উপায় কী?

মুসলমানরা এত দলে বিভক্ত কেন? আর বিভক্তি দূর করার উপায় কী?

প্রশ্ন: মুসলমানরা যেখানে এক এবং একই কুরআনের অনুসারী। তাহলে মুসলমানদের মধ্যে এতে বিভক্তি এবং চিন্তাধারার এত বিভিন্নতা কেন?

ডা. জাকির নায়েক এর উত্তর:

মুসলমানরা এত দলে বিভক্ত কেন? আর বিভক্তি দূর করার উপায় কী?

ক. মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত:

এটা অনস্বীকার্য ও দুঃখজনক বিষয় যে, আজকের মুসলমানরা নিজেদের মধ্যেই অসংখ্য ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। আর তার চেয়ে বেশি দুঃখজনক হলো এই বিভক্তি স্বয়ং ইসলামে আদৌ স্বীকৃত নয়। ইসলাম বলে তার অনুসারীদের মধ্যে ঐক্য এবং একতা লালন করতে।

কুরআন বলছে, واعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرقوا

অর্থ: এবং আঁকড়ে ধরো দৃঢ়তার সঙ্গে সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে (যা তিনি ঝুলিয়ে রেখেছেন তোমাদের জন্য কুরআনের আকারে) এবং নিজেরা বিভক্ত হয়ে যেও না। (৩: ১০৩) 

এ আয়াতে যে রজ্জুর কথা বলা হয়েছে তা কোন রজ্জু? মহাবিজ্ঞান আল-কুরআন সে আল্লাহর রজ্জু যা সমস্ত মুসলমানের সম্মিলিতভাবে আঁকড়ে ধরা উচিত।

এ আয়াতেই ঐক্যের ব্যাপারে দ্বিগুন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ‍ সবাই মিলে শক্ত করে ধরো এ কথা বলার সাথে সাথে বলা হয়েছে বিভক্ত হয়ো না।

কুরআন আরো বলছে, "আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের।" (৪:৫৯)

সকল মুসলমানের কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ অনুসরণ করা কর্তব্য এবং নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হওয়া অনুচিত।

খ. ফের্কাবাজী ও বিভক্তি ইসলামে নিষিদ্ধ।

কুরআন বলছে, 

"যারা নিজেদের দ্বীনকে খণ্ড খণ্ড করে দিয়েছে এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাদের সঙ্গে তোমার এতটুকু সম্পর্ক নেই। তাদের এসব ব্যাপার আল্লাহর কাছে ন্যস্ত। অবশেষে তিনি তাদেরকে বলে দেবেন সেই সকল সম্পর্কে যেসব কর্ম তারা করছিল।" -(সূরা আনআমঃ ১৫৯)

এ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ঐ সমস্ত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে যারা নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে।

কিন্তু (দুঃখের বিষয়) কেউ যখন কোনো মুসলমানকে জিজ্ঞেস করে- তুমি কে? সাধারণ জবাব হলো, আমি একজন সুন্নী অথবা আমি শিয়া।

অনেকেই নিজেদেরকে (একধাপ এগিয়ে) হানাফী অথবা শাফী অথবা মালেকী অথবা হাম্বলী ইত্যাদি হিসেবে পরিচিত হতে গর্ববোধ করেন। কেউ আবার দেওবন্দী। কেউ ব্রেলোভী বলে থাকেন।

গ. আমাদের রাসূল (স.) শুধু একজন 'মুসলিম' ছিলেন।

উপরোক্ত একজন মুসলমানকে কেউ যদি প্রশ্ন করে আমাদের প্রিয় নবী (স.) কী ছিলেন? তিনি কী একজন হানাফী অথবা শাফী অথবা হাম্বলী ছিলেন? না! তিনি ছিলেন একজন মুসলিম। তাঁর পূর্বে আগত আল্লাহর সমস্ত নবী ও রাসূলগণের মতো।

যেমন- সূরা নিসা ৫২ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ঈসা (আ) ছিলেন একজন মুসলিম।

৬৭ আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ইব্রাহীম না ইহুদী ছিল না খ্রীষ্টান, সে ছিল একজন মুসলমান।

ঘ. কুরআন বলছে নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দাও।

কেউ পরিচয় জানতে চাইলে তার বলা উচিত আমি একজন মুসলমান বা মুসলিম, না হানাফী না শাফী।

"আর কে হতে পারে বক্তব্যে তার চেয়ে উত্তম? যে (মানুষকে) আল্লাহর পথে আহবান করে, আর যাবতীয় জীবন-কর্ম যেভাবে আল্লাহ করতে বলেছেন সেভাবে করে এবং বলে, আমি তো মুসলিম (আল্লাহতে আত্মসম্পনকারীদের একজন)।" (৪১:৩৩)

অন্যত্র কুরআন বলে- “আমি তাদেরই একজন যারা আল্লাহতে সমর্পিত। অন্য কথায় বলো, আমি একজন মুসলিম।"

রাসূল (স.) অমুসলিম রাজা বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। সেই সমস্ত চিঠিতে তিনি সূরা আলে-ইমরানের এই আয়াত উল্লেখ করেছিলেন।

"তাহলে বলে দিন (ওদেরকে) তোমরা সাক্ষী থাকো একথার যে, আমরা সর্বান্তকরণে আল্লাহতে আত্মসম্পর্নকারী 'মুসলিম'।" (৩:৬৪)

ঙ. ইসলামের মহান ইমামগণের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান:

ইসলামের ইতিহাসে মহান ইমাম ও আলেমগণের প্রতি আমাদের সম্মানবোধ আন্তরিক হতে হবে। তাঁদের জীবন-নিংড়ানো জ্ঞান সাধনা মুসলিম জাতিকে জ্ঞান সম্পদে সম্পদশালী করেছে।

আল্লাহর দরবারে নিঃসন্দেহে তাঁরা পুরস্কৃত হবেন। সাধারণের মধ্যে কেউ যদি বিশেষ কোনো ইমামের রীতি পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তা অবশ্যই দোষের কিছু নয়।

কিন্তু (জাতীয়) পরিচয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের কারো নাম জড়িয়ে পরিচয় দেয়া এক রকম সংকীর্ণতার প্রকাশ। যেমনটা করতে তাঁরা কেউ বলে যাননি। নবী রাসূলগণের ন্যায় তাঁরাও ছিলেন শুধুমাত্র আল্লাহতে সমৰ্পিত 'মুসলিম'।

কাজেই তাঁদের কারো অনুসারী হলেই পরিচয় পরিবর্তন হয় না। মুসলমানদের পরিচয় একটাই- তারা মুসলিম।

অনেকেই হয়তো এক্ষেত্রে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংকীর্ণ মানসিকতাকে চাপা দেবার নিমিত্তে সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত ৪৫৭৯ নং হাদীস খানি নিয়ে তর্ক জুড়ে দিবেন। যা রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, “আমার উম্মত ৭৩টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে।”

কিন্তু এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁর উম্মতের অধঃপতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সমস্ত বিকৃতি দেখা দেবে তারই অন্যতম একটি আগামবার্তা বহন করছে। রাসূল (স.) তো একথা বলেননি যে, মুসলমানরা এভাবে ফের্কায়ে ফের্কায় ভাগ হয়ে যেতে হবে।

আল কুরআন যেখানে আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে কোনো ধরনের বিভক্তির সৃষ্টি করা যাবে না। অতএব যারা কুরআন ও শুদ্ধ হাদীসসমূহের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতার কারণ না হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করে তারাই সঠিক পথে রয়েছেন।

তিরমীযি শরিফের ১৭১ নং হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, "আমার উম্মত ৭৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। এর মধ্যে শুধুমাত্র একটি ছাড়া বাকি সব জাহান্নামী হবে।"

সাহাবীগণ জানতে চাইলেন, "হে আল্লাহর রাসূল! সেই শুদ্ধ (সঠিক)। দল কোনটি হবে?" রাসূল (স) বললেন, "যাদের কাছে আমি এবং আমার সঙ্গী সাথীরা অনুস্মরণীয় হবো।"

"আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের।" কুরআনের বহু স্থানে এই একটি কথা মুসলমানদের মনের ভেতর স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেবার জন্য বিভিন্ন ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কাজেই একজন মুসলমানের অনুস্মরণীয় আদর্শ হচ্ছে কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীস। এরপর এ দুয়ের নির্দেশনা সমূহকে অনুশীলনীর পদ্ধতি হিসেবে সে যদি বিশেষ কোন আলেমকে অনুসরণ করতে চায় তাতে দোষের কিছু নেই।

কিন্তু তা যদি আবার কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে স্বয়ং করআন ও হাদীসের বিরুদ্ধে চলে তাহলে বড় বিশেষজ্ঞ আলেমই হোক না কেন দুই পয়সা মূল্য রাখেন না।

প্রতিটি মুসলিম যদি তার সামর্থ অনুযায়ী কুরআন বুঝে পড়ার অনুশীলন করে এবং সেখান থেকে পাওয়া মূলনীতিসমূহ স্বয়ং রাসূল (স)-এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী প্রয়োগের চেষ্টা করে তাহলে ইনশাল্লাহ একদিন এই বিভক্তি দূর হয়ে যাবে এবং আমরা ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী এক 'উম্মাহ' হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হব।

Post a Comment

Previous Post Next Post