আল্লাহ যেহেতু আমাদের ভাগ্য আগেই লিখে রেখেছেন, তাহলে আমাদের মন্দ কাজের জন্য দায়ী কে?

প্রশ্নকর্তা: আমি পবিত্র কোরআনে পড়েছি যে, আল্লাহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এ কথা শুনে একজন ব্যক্তি আমাকে বলল যে, যেহেতু আল্লাহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন সেহেতু আমি যে পাপ করি সেটাও আল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং একজন ব্যক্তি মুসলিম হবে কি অমুসলিম হবে সেটাও আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? আমি এখানে তাকদীর তথা অদৃষ্ট সম্বন্ধে জানতে চাচ্ছি।

আল্লাহ যেহেতু আমাদের ভাগ্য লিখে রেখেছেন, তাহলে আমাদের পাপ কাজের জন্য দায়ী কে?

আল্লাহ যেহেতু আমাদের ভাগ্য আগেই লিখে রেখেছেন, তাহলে আমাদের মন্দ কাজের জন্য দায়ী কে?

উত্তরে ডা. জাকির নায়েক: আপনি কোরআনের যে কথাটি বললেন প্রকৃতপক্ষে সেটা অদৃষ্ট সম্বন্ধে নয়। আর এখানে শব্দটা নিয়ন্ত্রণ হবে না; বরং হবে সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান এবং এ দুটো ধারণার মধ্যে পার্থক্য আছে। যাই হোক, এখন অদৃষ্ট সম্পর্কে আসা যাক, অনেকের মধ্যেই অদৃষ্ট বা তাকদীর সম্পর্কে ধারণা হলো যে, আল্লাহই সবকিছু নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে, কোনো চোর যদি চুরি করে এর জন্য দায়ী কে হবে? নিশ্চয়ই তিনি যিনি চুরি করাটা তার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন। যদি কারও তাকদীরে লিখা থাকে যে, সে মানুষ হত্যা করবে তাহলে সেই হত্যার জন্য ঐ ব্যক্তি দায়ী হতে পারে না, বরং দায়ী হবে অদৃষ্টের লেখক অর্থাৎ আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ)।

এমন কি, কারও অমুসলিম হওয়াটা যদি তার ভাগ্যে লেখাই থাকে তাহলে সে দোযখে যাবে কেন? প্রকৃতপক্ষে এখানে যে সমস্যাটা হচ্ছে তা হলো, কদরের অর্থ বুঝতে ভুল করা। আমাদের অদৃষ্টে বিশ্বাস করতে হবে, এটা নিয়ম।

কিন্তু সাথে আমাদের এটা জেনে নিতে হবে যে, অদৃষ্ট বলতে কী বুঝায়? এটাকে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যেতে পারে। ধরুন, একটা ক্লাসে এক'শ জন বসে আছে। ক্লাসটি হচ্ছে বছরের শেষ দিকে বার্ষিক পরীক্ষার আগে। ক্লাসে শিক্ষক ছাত্রদের দেখিয়ে বলছেন, তুমি হবে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। তুমি পাবে সেকেন্ড ক্লাস আর তুমি ফেল করবে।

এখন বার্ষিক পরীক্ষা হলো এবং পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেখা গেল প্রথমজন ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছে, দ্বিতীয় জন সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে এবং তৃতীয় জন ফেল করেছে। এখন তৃতীয়জনের ফেল করার জন্য কি টিচারকে বলার সুযোগ আছে যে, আপনি বলেছিলেন বিধায় আমি ফেল করেছি? না এ সুযোগ নেই।

কারণ, উক্ত শিক্ষক তাদের এক বছর পড়িয়েছেন, তাই তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে উক্ত ছাত্রদের পারফরমেন্স দেখে অনুমান করেছেন যে, কে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে, কে সেকেন্ড ক্লাস পাবে আর কে অমনযোগী বিধায় খারাপ করবে? এখানে শিক্ষকের এ অনুমানকে দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই।

ঠিক তেমনি বিশ্বজাহানের স্রষ্টা আল্লাহ, তিনি এ টিচারদের থেকেও অনেক অনেক ঊর্ধ্বে এবং তাঁর আছে ইলমুল গায়েব অর্থাৎ তিনি ভবিষ্যতের কথাগুলো জানেন। এগুলো তিনি একটি কিতাবে লিখে রেখেছেন।

সুতরাং মানুষ ভবিষ্যতে কী করবে, এটা আল্লাহর জানা আছে বলে তাকে ঐ কর্মের জন্য দায়ী করা হবে, এমনটি করার সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ মনে করি, একজন লোকের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য পাঁচটি রাস্তা সামনে আছে।

আল্লাহ পূর্ব হতে জানেন যে, লোকটি দ্বিতীয় রাস্তাটি বেছে নেবে তাই তিনি সেটা লিখেছেন। এখানে লক্ষ্য করা দরকার যে, তিনি লিখে রেখেছেন বলে লোকটি দ্বিতীয় রাস্তা দিয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়; বরং লোকটি দ্বিতীয় রাস্তা দিয়ে যাবে বলেই আল্লাহ সেটা লিখে রেখেছেন।

আবার ধরুন, আপনি একজন ভালো ছাত্র। ইন্টার পরীক্ষায় আপনি পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গণিতে এ প্লাস পেয়েছেন। এখন আপনি ডাক্তারও হতে পারেন আবার ইঞ্জিনিয়ারও হতে পারেন। আপনি ঠিক করলেন আপনি ডাক্তার হবেন।

আল্লাহ জানেন আপনার চয়েস দুটো, তবে আপনি ডাক্তার হবেন। তাই আল্লাহ তা লিখে রেখেছেন। এরপর আপনি যখন রুজি রোজগার শুরু করবেন তখন আপনি সৎভাবেও কামাই করতে পারেন আবার দুর্নীতিও করতে পারেন।

ধরি, আপনি আপনার রোজগার দুর্নীতির মাধ্যমে করলেন। এক্ষেত্রেও আল্লাহ তা পূর্বে থেকেই জানেন বলে তিনি লিখে রেখেছেন। এমন নয় যে, তিনি আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন বলেই আপনি হারাম পথে রোজগার করবেন। এটাই হল তাকদীর তথা অদৃষ্ট।

তবে তাকদীরের কিছু জিনিস আছে নির্ধারিত। যেমন: কে কখন জন্মাবে, কার মৃত্যু কখন হবে ইত্যাদি। আল্লামা ইকবাল বলেন, “খুদ কো কর, ইতনা বুলন্দ কেয়া তাকদীর কে পেহলে আল্লাহ আপনে বান্দাছে পুছলে কে বাতাদে রাজা কেয়া হ্যায়।”

অর্থাৎ‍, নিজেকে এতটাই মহান বানাও যে অদৃষ্ট লেখার পূর্বে আল্লাহর নিজের বান্দাকে জিজ্ঞাসা করবেন যে, তোমার ইচ্ছা কি? সুতরাং আমাদের অপরাধগুলোর জন্য আমরাই দায়ী। কেউ যদি চুরি করে সে চুরির জন্য সেই দায়ী।

এজন্যই আল্লাহ আমাদের জন্য দিক নির্দেশনামূলক গ্রন্থ কোরআন পাঠিয়েছেন। যে কোরআন মেনে চলবে না এর জন্য দায়ী সে-ই হবে অন্য কেউ নয়।একইভাবে যারা অমুসলিম তাদের এ অবস্থার জন্য দায়ী কে?

এ ব্যাপারে হাদীসে এসেছে যে, প্রত্যেকটি শিশু প্রকৃতিগতভাবে মুসলিম হয়ে জন্মায়, পরবর্তীতে তার গুরুজনেরা তাকে পথভ্রষ্ট করে। সুতরাং কারও অমুসলিম হওয়া আল্লাহ নির্ধারিত করে দেননি।

কারণ, একজন অমুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুযোগ আছে যে, সে তার বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে কোরআন অধ্যয়ন করে মুসলিম হতে পারবে। আর এজন্যই হাশর ময়দানে বিচার করা হবে মানুষের কর্মের আলোকে। যে ভালো কাজ করবে সে জান্নাত পাবে। আর যে মন্দ কাজ করবে সে হবে জাহান্নামের অধিবাসী।

Post a Comment

Previous Post Next Post