চোখ ওঠার কারণ ও প্রতিকার। চোখ ওঠার ঘরোয়া চিকিৎসা।

এ বর্ষায় চোখ ওঠা সারাতে ও সংক্রমণ এড়াতে যা করণীয়।

ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নানান রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। আর বর্ষায় সবচেয়ে সাধারণ সংক্রমণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কনজাংটিভাইটিস বা কনজাংটিভার।

তবে স্থানীয়ভাবে এটি চোখ ওঠা নামেই পরিচিত। এ সময় অনেকেই চোখ ওঠার সমস্যায় ভোগে থাকেন। যা অত্যন্ত সংক্রামক ও বেশ যন্ত্রণাদায়ক বটে।

সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অ্যালার্জির কারণে কনজেক্টিভাইটিস হতে পারে। এ রোগের শুরুতে এক চোখ আক্রান্ত হয়, পরে অন্য চোখে তা ছড়িয়ে পড়ে। 

চোখ ওঠার কারণ ও প্রতিকার। চোখ ওঠার ঘরোয়া চিকিৎসা।


চোখের নিচের অংশ ফুলে যায় এবং লাল রং ধারণ করে পাশাপাশি চোখ চুলকাতে থাকে। অধিক আলোয় চোখে অস্বস্তিদায়ক অনুভূতি জন্মায় এবং চোখে ব্যথা শুরু হয়।

অনেক সময় সকালে ঘুম থেকে উঠলে চোখে কিছু পড়েছে, চোখের পাতা আটকানো বা ভারী আঠালো কিছু চোখের চারপাশে জমে আটকে আছে এমন অনুভূতি জন্মায়, এসময় চোখ চুলকানোর পাশাপাশি ভীষণ জ্বালাপোড়াও করে।

আবার সবকিছু ঘোলাটে দেখা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখের কোণায় ময়লা জমে আটকে থাকে। কোনো ব্যক্তির এমন ঘচনা ঘটলে তাকে সাধারণত চোখ ওঠা রোগ বলা হয়।

কনজেক্টিভাইটিস বা চোখ উঠা থেকে নিরাপদ থাকতে করণীয় কী?

চোখের সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধে ঢাকার শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহনুর হাসান কিছু পেশাদার টিপস দিয়েছেন। আর তা হলো—

▶ চোখ ঘষা বা স্পর্শ করা এড়িয়ে চলুন।

চোখ ওঠার সমস্যা হলে চোখ চুলকানো শুরু হয়।  এতে সাময়িক উপশমের জন্য বারবার চোখ ঘষা বা স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

কেননা এতে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে, এমনকি এক চোখ থেকে অন্য চোখেও তা দ্রুত ছড়াতে পারে।

চোখের চারপাশ থেকে যে কোনো স্রাব পরিষ্কার করতে একটি ভেজা ওয়াশক্লথ বা তুলা ব্যবহার করুন। এক্ষেত্রে টিস্যু বা নরম কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করা যেতে পারে। 

ব্যবহার করা সেই টিস্যু, কাপড় বা তুলা সাবধানে নিরাপদ স্থানে ফেলতে হবে।

▶ চোখে কন্টাক্ট লেন্স পরবেন না।

চোখ ওঠার সমস্যা একেবারে নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত ভুলেও কন্টাক্ট লেন্স চোখে পরবেন না। আর অবশ্যই লেন্সগুলো পরিষ্কার করতে ভুলবেন না।

না হলে তাতে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস থাকতে পারে ও আবারো চোখের সংক্রমণজনিত সমস্যায় ভুগতে হতে পারে। এসময় চোখের প্রসাধনী ব্যবহার করা থেকে একদম বাদ দিতে হবে। 

▶ সাবান-গরম পানি দিয়ে হাত ধুতে থাকুন।

কনজেক্টিভাইটিসে আক্রান্ত হলে সাবান-গরম পানি দিয়ে কমপক্ষে ২ সেকেন্ডের জন্য ঘন ঘন হাত ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন।

এছাড়া প্রত্যেকবার সংক্রামিত চোখ পরিষ্কার করার আগে ও পরে বা চোখের ড্রপ বা মলম প্রয়োগ করার আগে হাত ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে ফেলুন।

▶ ফোলাভাব কমাতে ভাপ নিন।

ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে চোখের ফোলাভাব কমাতে একটি পরিষ্কার কাপড় ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে আলতো করে চোখের উপরে কিছুক্ষণ রেখে দিতে পারেন আবার খুব জোরে চোখের উপর চাপ দেবেন না। চাইলে গরম পানিতেও কাপড় ভিজিয়ে চোখে ভাপ নিতে পারেন।

▶ চারপাশ স্যানিটাইজ করুন।

যেহেতু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে সাধারণত চোখ ওঠা রোগ হয়, তাই আপনার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, রিমোট, অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী এবং দৈনন্দিন জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখুন।

গরম পানি দ্বারা তোয়ালে, বালিশের কভার ও বিছানার ছাদর, বাড়ির দরজা ও জানালার পর্দা পরিষ্কার রাখুন। 

এছাড়া আক্রান্তের তোয়ালে ও বালিশ যেন অন্য কেউ ব্যবহার না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

▶ পর্যাপ্ত পানি পান করুন।

চোখে ওঠায় আক্রান্ত ব্যক্তির চোখের শুষ্কতা ও জ্বালা ভাব কমাতে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। এ সম্পর্কে ভারতের এক সার্টিফাইড নিউট্রিশনিস্ট ডা. রোহিনী প্যাটেল (এমবিবিএস) বলেছেন— "সঠিক হাইড্রেশন ও স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। এতে চোখকে আর্দ্র রাখতে ও কনজেক্টিভাইটিসের ফলে চোখের শুষ্কতা ও জ্বালা ভাব কমাতে বেশ কার্যকরি।"

▶ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।

চোখের ছানি পড়া, ঝাপসা দেখা দূর করতে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বেশ উপাদেয়। এছাড়াও ভিটামিন সি একটি কার্যকরি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা চোখের কোষ নষ্ট হওয়া রোধ করে।

তাই দ্রুত চোখ ওঠা নিরাময়ে প্রতিদিন খাবারে তালিকায় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন। সাইট্রাস ফল (যেমন—কমলা, জাম্বুরা ও লেবু), স্ট্রবেরি, কিউই, পেয়ারা ইত্যাদি ফল ভিটামিন সি এর উৎস।

▶ বিটা—ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।

সুস্থ ও স্বাভাবিক দৃষ্টি বজায় রাখতে ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সমর্থন করার জন্য বিটা—ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিটা—ক্যারোটিন দেহে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়।

এজন্য খাবারে গাজর, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া, মটরশুঁটি, পালংশাক, বাঁধাকপি, লাল ও হলুদ ক্যাপসিকাম, শালগম, টমেটো, লেটুসপাতা, লাল মরিচ, মটর, ব্রুকলি, স্কোয়াশ ইত্যাদি খাবারে রয়েছে বিটা—ক্যারোটিন।

এছাড়া দেশীয় ফলের মধ্যে আম, তরমুজ, পাকা বরই, বাঙ্গি, বেরিজাতীয় ফলও বিটা ক্যারোটিনের অংশ। 

এসকল ফল ও শাকসবজি উচ্চ তাপে রান্না করার বদলে অল্প তাপে সামান্য রান্না করে কিংবা সম্ভব হলে কাঁচা খেলে বিটা—ক্যারোটিন সমৃদ্ধ পুষ্টিমান বেশি পাওয়া যায়।

▶ ওমেগা—৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। 

ওমেগা—৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রদাহবিরোধী কার্যকরি বৈশিষ্ট্য আছে, যা চোখের প্রদাহ কমাতে ও চোখের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে এবং চোখের রেটিনাকে সুস্থ রাখে।

তাই চর্বিযুক্ত মাছ (যেমন: স্যামন, ম্যাকেরেল, সার্ডিন ও ট্রাউট) ও ওমেগা—৩ এর উদ্ভিদ-ভিত্তিক উৎস (ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া বীজ, আখরোট ও শণের বীজ) খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন।

গবেষণার তথ্যমতে, স্যামন মাছ চোখের চারপাশে বার্ধক্যের ছাপ প্রতিরোধ করতে সহায়ক।

▶ অ্যালার্জেন এড়িয়ে চলুন।

চোখ ওঠায় সম্ভাব্য বিরক্তিকর ও অ্যালার্জেনগুলো এড়িয়ে চলুন আর তা না হলে এতে চোখের ক্ষতি হতে পারে। ধোঁয়া, ধুলো, পোষা প্রাণীর লোম অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

তাই এ ধরনের যে কোনো পদার্থ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। সম্ভব হলে চোখে চশমা ব্যবহার করুন।

এতে চোখে স্পর্শ করা কমবে এবং ধুলাবালু, ধোঁয়া থেকে চোখ রক্ষা পাবে। প্রচন্ড আলোয় চোখের অস্বস্তিদায়ক সমস্যাও কমবে।

আর অবশ্যই চোখ ওঠার সমস্যা সারাতে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ সময়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। তবে চোখ ওঠা রোগে ভয়ের কোনো কারণ নেই।

চোখ উঠলে কতদিন থাকে?

সাধারণ ৬ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই এটি ভালো হয়ে যায়। চোখ ওঠার চিকিৎসার পাশাপাশি উপরোক্ত নিয়ম মেনে চললে দ্রুত রোগীর সুস্থতা মিলবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post