আরবি দশম হিজরী সনে রাসূল (সাঃ)-এর বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষাধিক সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। যে কোন আদর্শিক নেতার জীবনের সর্বশেষ কর্মী সম্মেলনে দেওয়া ভাষণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) কেবল নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন শেষনবী ও বিশ্বনবী। অধিকন্তু তাঁর দৃঢ় আশংকা ছিল যে, এটাই তাঁর জীবনের সর্বশেষ হজ্জ ও সর্বশেষ বিশ্ব সম্মেলন। আর নবী জীবনের পরিপূর্ণতা সাধিত হয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিদায় হজ্জের ভাষণে।
আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন দ্বিন ইসলামকে বিজয়ী ও পূর্ণতা দানের জন্য। যখন দ্বিন ইসলাম বিজয় ও পূর্ণতা লাভ করে তখন তিনি তাঁর বিদায়ের কথা অনুভব করেন।
দশম হিজরীতে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার সাহাবির সামনে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ বিকালে আরাফাতের ময়দানে যে বক্তব্য পেশ করেন এবং পরদিন ১০ জিলহজ ঈদের দিন ও কোরবানির দিন প্রদান করেছিলেন। এই দুইদিনে দেওয়া তাঁর বক্তব্য বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে পরিচিত।
তাই তিনি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা)-কে ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণকালে বলেছিলেন, ‘হে মুয়াজ, সম্ভবত এ বছরের পর আমার সঙ্গে তোমার আর সাক্ষাৎ হবে না। হয়তো তুমি আমার মসজিদ ও আমার কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে।’
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণ:
১. হে জনতা, আমার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনো, আমি জানি না, এবারের পর তোমাদের সঙ্গে এ জায়গায় আর একত্র হতে পারব কি না।
২. হে মানবমণ্ডলী, স্মরণ রাখো, তোমাদের আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। তোমাদের আদি পিতা একজন, অনারবদের ওপর আরবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তদ্রূপ সাদার ওপর কালোর কোনো প্রাধান্য নেই। আল্লাহ ভীতিই শুধু শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার মানদণ্ড।
৩. তোমাদের পরস্পরের রক্ত ও ধন-সম্পদ আজকের দিন, এ মাস এবং এ শহরের মতো পবিত্র। ৪. শোনো, জাহেলিয়াতের সব কিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের রক্তের দাবিও রহিত করা হলো।
৫. জাহেলি যুগের সুদ রহিত করা হলো। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি রহিত করছি তা হলো, আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সুদ। এখন থেকে সব ধরনের সুদ হারাম করা হলো।
৭. আমি তোমাদের কাছে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অন্যটি হলো আমার সুন্নাহ।
৯. হে মানবমণ্ডলী, পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী হবে না এবং পুত্রের অপরাধে কোনো পিতাকে দায়ী করা হবে না।
১০. তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হবে। তোমরা তখন কী বলবে? সাহাবায়ে কেরাম প্রত্যুত্তরে বলেন, আমরা সাক্ষ্য দেব যে আপনি দ্বিনের দাওয়াত দিয়েছেন, আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।
মহানবী (সাঃ) এ কথা শুনে শাহাদাত আঙুল আকাশের দিকে উত্তোলন করে লোকদের দিকে ঝুঁকিয়ে তিনবার বলেন, হে রব, আপনি সাক্ষী থাকুন (সহিহ মুসলিম)।
১১. প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই। তোমরা তোমাদের দাস-দাসী সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরও তা পরতে দেবে। তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবে। শাস্তি দেবে না।
১২. হে মানবজাতি, ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না। কেননা অতীতের অনেক জাতি এ বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে। উপস্থিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব হবে আমার এ কথাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
মহানবী (সাঃ) ভাষণ শেষ করলেন। এবং তাঁর চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি করুণ স্বরে করুণভাবে আকাশ পানে তাকালেন এবং তিনি বললেন, ‘হে মহান প্রভু! হে পরওয়ার দিগার! আমি কি তোমার দীনের দাওয়াত পরিপূর্ণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। তখন উপস্থিত জনতা সবাই সম্মিলিতভাবে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আপনার দীন পরিপূর্ণভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন।‘ তখন তিনি আবার বললেন যে, ‘হে প্রভু! আপনি শুনুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এরা বলেছে আমি আপনার দীনকে লোকদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছি।‘
ভাবের আতিশয্যে নবী নীরব হলেন। জান্নাতি নূরে তাঁর চেহারা আলোকদীপ্ত হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে কুরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয়। ‘আজকের এই দিনে তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’
হযরত রাসূল (সাঃ) কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। জনতাও নীরব। কিছুক্ষণ পর হযরত (সাঃ) জনতার দিকে তাকালেন এবং করুণ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বিদায় বন্ধুগণ, বিদায়।
হজরত রাবিয়া ইবনে উমাইয়া ইবনে খালফ জনতার কাছে উচ্চকণ্ঠে বিদায় হজ্জের ভাষণ এর বাণী পৌঁছে দেন (ইবনে হিশাম)।
(আল-কোরআন, পারা: ৬, সূরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৩)। (বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা; সীরাতুন নবী (সা.), ইবনে হিশাম (র.), খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২৭৩-২৭৭; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর (র.), খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ১৯৮ ও ৩২০-৩৪২, ই. ফা. বা.)।